আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। শিশুরা সদ্য ফুল বাগানের ন্যায়। এদেরকে যেভাবে পরিচর্যা করা হবে, সেভাবেই ফুল ফুটবে। ফুলের সদ্য বাগানকে যেভাবে পরিচর্যা করা হয় যেমন, নিয়মিত পানি দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা, পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া, শুকনা ডাল পালা কেটে দেওয়া, বর্ষায় যাতে পানি না জমে কিংবা অতিরিক্ত রোদে গাছ যাতে পুড়ে না যায় লক্ষ্য রাখা সর্বোপরি পরিচর্যার ফলে একটি বাগান ভরে ওঠে সুন্দর ফুলে এবং সুবাস ছড়িয়ে দেয় আমাদের মাঝে। ঠিক তেমনি একটা মানব শিশুকে আমরা যেভাবে পরিচর্যা করব ঠিক সেভাবেই বেড়ে উঠবে। বীজ বপন হবে নৈতিকতা, মানবতা, সততা, শ্রদ্ধাবোধ, সৃজনশীলতার। শিশু নরম কাদার মত থাকে কৈশোর পর্যন্ত। এই নরম মাটিতে যেভাবে ছাচ দেওয়া হয় মাটি যখন শক্ত হয় ছাচের ছাপ থেকে যায়, শিশুরাও তেমন। সুতরাং এই শিশুবয়স থেকে কৈশোর পর্যন্ত শিশুর দিকে আমাদের অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হয় যথাসম্ভব। সেক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও চেষ্টার কমতি থাকে না। আমাদের সন্তান কোন খারাপ সঙ্গে মিশছে কিনা, রাত জাগছে কিনা, দুষ্টুমি করছে কিনা, পড়াশুনা ঠিকমত করছে কিনা ইত্যাদি খোঁজ রাখা হয়। আমরা অভিভাবকরা এটা জানি যে শিশুরা অনুকরন প্রিয়, যা দেখে সেটা অনুকরণ করে এবং অনুকরণ অনেকক্ষেত্রে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় অথবা মনের ভিতর রেখে এটা নিয়ে ভাবতে থাকে যা আমাদের অভিভাবকদের কাছে এটা সাময়িকভাবে স্বাভাবিক মনে হতে পারে, আমাদের একটা ধারণা আছে যে শিশু বড় হলে এটা ঠিক হয়ে যাবে অথবা শিশুরা এমন করতেই পারে।
বর্তমান পৃথিবী তথ্য প্রযুক্তির বিল্পবের ফলে আমদের হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিয়েছে যার অন্যতম কয়েকটি মাধ্যম হচ্ছে স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট। যার প্রত্যেকটা মাধ্যম অধিকাংশ মানুষের হাতের নাগালে। আমাদের সময় নব্বই দশক পর্যন্ত এগুলো ছিলো দুষ্প্রাপ্য, যা আবার একটা বয়স না হলে আমরা পেতাম না হাতের নাগালে। বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সর্বাধিক ব্যবহৃত সাইট গুলো ইউটিউব, ফেসবুক, গুগল সার্চ ইঞ্জিন, ইন্সতাগ্রাম, স্নাপচ্যাট, টিকটক, লাইকি ইত্যাদি।ইন্টারনেটের পরিসেবাগুলো আমরা অকপটেই শিশুর সামনে ব্যাবহার করছি অথবা শিশুর হাতে তুলে দিচ্ছি তার চাওয়ার জন্য হতে পারে, তার খাবার সময় স্থির রাখার জন্য,ঘরের ভিতর যাতে শান্ত থাকে সেই জন্য অথবা শুধুই তার বিনোদনের জন্য কার্টুন অথবা গেমের মাধ্যমে। বিভিন্ন জরিপ গবেষনা করে দেখা যায় যে বর্তমানে অভিভাবকরা শুধুমাত্র ইউটিউব ও গেমসের জন্য প্রথম তার স্মার্টফোনটা তুলে দিচ্ছে শিশুটির হাতে।
ইউটিউবের মাধ্যমে শিক্ষনীয় কোন ভিডিও অথবা কার্টুন দেখানো হচ্ছে আর গেম এর মাধ্যমে তাকে স্থির/শান্ত রাখার প্রয়াস চলছে। যা আমরা খুবই স্বাভাবিক ভাবেই দেখছি। যে বাচ্চাটি যত অল্প বয়সে স্মার্টফোনের বিভিন্ন এ্যাপস বা অপশন ব্যবহার করছে তাদের অনেক মেধাবী বলেও বাহবা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আপনি কখনো কি ভেবেছেন যখন আপনার সন্তান বাইরে যাচ্ছে, তখন আপনি তাকে কত বিষয়ে সাবধান করে দিচ্ছেন যেমন- কেউ কিছু দিলে খাবে না,কেউ ডাকলে যাবে না,খারাপ ছেলেদের সাথে খেলবে না,খোলা খাবার খাবে না ইত্যাদি এমনকি এগুলোর না করার যথার্থ কারন সহকারে অধিকাংশ অভিভাবকরা বুঝিয়ে থাকে, আর আপনি আপনার সবচেয়ে প্রিয় শিশু সন্তানকে এই স্মার্টফোনের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর ভাল খারাপ সব কিছুর মাঝে কোন দিক নির্দেশনা না দিয়েই ছেড়ে দিচ্ছেন।
হ্যাঁ, ঠিক বলছি, ভেবে দেখেছেন কি আপনার শিশুর হাতে স্মার্টফোন দিয়ে ঘরে রেখেই মনে করছেন আপনি নিশ্চিন্ত কিন্তু সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার কারণ হওয়া উচিত এটা। একটা ধারালো ছুরির দুই ধরনের ব্যবহার হতে পারে যেমন, ডাক্তার একটা ধারালো ছুরি দিয়ে অপারেশন কক্ষে এক জন মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে অপর দিকে এক জন ছিনতাইকারি এই ধারালো ছুরি দিয়ে একটা মানুষের জীবন নিতে পারে।ঠিক তেমনি শিশুর হাতে স্মার্টফোন টা দেওয়ার আগে কখোনো নিজে স্ক্রল করে দেখেছেন কি এটার ভিতরে কোন কোন খারাপ দিক আছে যেটা থেকে আপনার শিশুর জন্য খারাপ বা নিষিদ্ধ ,তার এই বয়সে যেটা দেখার মত উপযুক্ত নয় বা অপরিচিত কারো সাথে যোগাযোগ করছে আপনারই পাশে থেকে যেটা আপনার চিন্তাতেই আসছে না। আমাদের ভাবার সময় এসেছে এখন , কারণ পুরো পৃথিবীর বুকে আপনার সন্তানকে আপনি ছেড়ে দিচ্ছেন একা।
আর একটি অজানা আকর্ষনে অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। যেটার প্রতিফলন এখনই আমরা সমসাময়িক অনেক গুলা ঘটনা পপর্যবেক্ষণ করলেই আমাদের আশেপাশেয় দেখতে পারছি।
-বিভিন্ন সাইবার অপরাধের সাথে জড়িত হচ্ছে শিশু কিশোররা।যেমনঃ সাইবার বুলিং,কিশোর গ্যাং গ্রুপ এর মাধ্যমে একে অপরের সাথে দ্বন্দে জড়ান , হ্যাকিং,অপরিচিত মানুষের কাছে নিজের ও পরিবারে ব্যাক্তিগত তথ্য প্রকাশ ইত্যাদি।
-পর্নগ্রাফি আসক্তি।
-নিজেকে পরিবার থেকে আলাদা রেখে একাকি থাকা যার মাধ্যমে বিষাদ গ্রস্থ হচ্ছে জীবনযাপন,নিচ্ছে আআত্মহত্যার মত নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত। উদাহরণ হিসাবে দেখা যাচ্ছে বর্তমানে অধিকাংশ কিশোর বা কিশোরী দের আত্মহত্যার আগে সোস্যালমিডিয়া তে স্ট্যাটাস দেওয়ার প্রবনতা যেটা তার পরিবারের সাথে শেয়ার করলে হয়তো বা বেঁচে যেত অনেক গুলা ফুলের মতো জীবন।
-বিভিন্ন গেমস আসক্তি।
-শারীরিক ও মানসিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়া।
-সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়।
-সৃজনশীল মানসিকতা তৈরি না হওয়া। ইত্যাদি।
আমাদের বাস্তবিক জগৎ-এ চলার পথে যেমন আইন শৃঙ্খলা মানতে হয়, আইন ভঙ্গ করলে প্রচলিত আইনের আওতায় শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে ঠিক তেমনি সাইবার জগতেও দেশীও এবং আন্তর্জাতিক সাইবার আইন রয়েছে, যা ভঙ্গ করলে আপনি সাইবার আইনের আওতায় শাস্তি পাবেন সে যেই হোক শিশু কিশোর অথবা আমি আপনি। সুতরাং আমাদের প্রত্যেককেই ইন্টারনেট / সাইবার জগৎ এর খারাপ দিক গুলার অপকারিতা সর্ম্পকে জানাতে হবে, সন্তানদের সচেতন করে তুলতে হবে। সাইবার আইন সর্ম্পকে নিজে জানতে হবে ও সন্তানকে জানাতে হবে এবং নিজের শিশু সন্তানের হাতে আপনার ডিভাইসটা তুলে দেওয়ার আগে নিজে ভেবে দেখুন কখন এটা তুলে দেওয়ার উপযুক্ত সময় এবং কাদের সাথে আপনার সন্তানের সর্ম্পক গড়ে উঠছে, বন্ধু হয়ে আপনি শুনুন আপনার সন্তান থেকে অভিভাক হয়ে নয়, শুরু হোক এখান থেকেই গোড়ে উঠুক আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ সুন্দর একটি সাইবার দুনিয়া।
মোঃ আসসাফফাত সুহৃদ
সাইবার ‘ল’ কনসালট্যান্ট,
চেয়ারম্যান, ক্লাইন্ট টাচ ইন্টারন্যাশনাল
ম্যানেজিং ডিরেক্টর, শেফ টনি খান গ্লোবাল ইন্সটিটিউট
ইমেইলঃ [email protected]